পলিথিন ব্যবহারকে কি সরকার উৎসাহিত করল
পরিবেশ সুরক্ষার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে আমরা চতুর্থ স্থান দখল করেছি, তবে শুরুর দিক থেকে নয়, পেছন দিক থেকে! দুই সপ্তাহ আগে প্রকাশিত বিশ্ব পরিবেশ সুরক্ষা সূচকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭তম। এর আগে ২০২০ সালে তালিকায় ১৬২তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পরিবেশ সুরক্ষা এজেন্সি (ইপিআই) থেকে দুই বছর পরপর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। তার মানে দুই বছরে পরিবেশ সুরক্ষায় আমরা ১৫ ধাপ পিছিয়ে পড়েছি।
বাংলাদেশের এ করুণ অবস্থার বিষয়টি আগে থেকেই আন্দাজ করা যায়। দূষিত বায়ু, দূষিত মাটি, দূষিত পানির দেশ হিসেবে বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানের তালিকায় বারবার আমাদের নাম উঠছে। দেশের পাহাড়-টিলা-বনজঙ্গল সব ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। আর নদীগুলোর কথা কী বলব! বাংলা ব্যাকরণে সবচেয়ে বেশি মুখস্থ করা রচনা সম্ভবত নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। সেই দেশের নদীগুলোর দিকে তাকালে চোখ ভিজে আসারই কথা যেকোনো প্রকৃতি অন্তঃপ্রাণের। নদী শুকিয়ে মরার পেছনে আন্তর্জাতিক পানি কূটনীতির বড় দায় আছে। কিন্তু দূষণের দায় তো পুরোপুরি এ দেশের সরকার ও নাগরিকদেরই নিতে হবে।
সিলেটে একের পর এক বন্যার অনেকগুলো কারণের মধ্যে সুরমাসহ সেখানকার নদী–খালগুলোর তলদেশ ভরে গেছে। বুড়িগঙ্গার দূষণ নিয়ে সব ধরনের সংবাদমাধ্যমে যত প্রতিবেদন হয়েছে, গোটা দেশের সব নদীর দূষণ নিয়েও অতটা হয়নি সম্ভবত। আর কর্ণফুলীতে তো বর্জ্যের চরই পড়ে গেছে বলে আমরা খবরে দেখতে পাই। নদী-খাল-বিল দূষণে সবচেয়ে বড় ‘অবদান’ রাখছে পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য। কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিনে সমুদ্রের ঢেউ থেকেও প্লাস্টিক বর্জ্য আছড়ে পড়ে এখন। করোনা মহামারি এসে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাবধানী হতে গিয়ে আমরা পরিবেশেরই সর্বনাশ করে ফেলেছি যেন। আমাদের ওয়ান টাইম প্লাস্টিক ও পলিথিনের অতি ব্যবহার আরও বেশি কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জেলা, উপজেলা, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা শহরগুলোতে এখনো কার্যকর কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। শুধু ঢাকা শহরের বাসিন্দা আনুমানিক দুই কোটি। চারজন হিসাবে পরিবার সংখ্যা ৫০ লাখ। এখন প্রতিটি ঘর থেকেই বর্জ্য ফেলতে ব্যবহৃত হয় প্রতিদিন একাধিক পলিথিন। তাহলে পুরো মাসে অর্ধকোটি পরিবার থেকে কী পরিমাণ পলিথিন বের হয়? ঘরে ঘরে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য সংগ্রহের বিষয়টি পুরোপুরি পলিথিননির্ভর হয়ে পড়েছে। সিটি ও পৌরসভা কর্তৃপক্ষগুলো টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না তোলে পলিথিনে বর্জ্য ফেলাতেই পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে। তা ছাড়া প্রতিটি পরিবার বাজার করতে গিয়ে একাধিক পলিথিন নিয়ে ঘরে ঢুকছে। অথচ দুই-তিন যুগ আগেও এই পলিথিন-সংস্কৃতি আমাদের ছিল না। পরিকল্পনা ও সদিচ্ছার অভাবে আমরা দিন দিন পলিথিন ও প্লাস্টিকনির্ভর জীবনে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষ দশমে। ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর এগুলোর ৮০ শতাংশ মাটিতেই ফেলা হচ্ছে। সেগুলোর ঠাঁই হচ্ছে নালা–খাল–নদী হয়ে সর্বশেষ বঙ্গোপসাগরে। নদী হয়ে সাগরে যাওয়া প্লাস্টিক ও পলিথিন–দূষণে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ষষ্ঠ স্থানে। সম্প্রতি জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়সহ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণা বলছে, ঢাকা মহানগর প্লাস্টিক ও পলিথিনের বোমার ওপর বসে আছে। এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বড় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এবারের প্রস্তাবিত বাজেটেও সব ধরনের পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যাগ ও মোড়কের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করে নিয়েছে সরকার। গত অর্থবছরে এসব সামগ্রীর ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, সেটি এবার নেই। এর মাধ্যমে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর অভিমত হচ্ছে, সরকার পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহারকে একপ্রকার উৎসাহিতই করল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনেকে বলছেন, ব্যবসায়ীদের সুবিধা করে দিতেই এমন সিদ্ধান্ত সরকারের। কারণ, কোনো পণ্যের প্লাস্টিক ব্যাগ ও মোড়কের পেছনে বিভিন্ন কোম্পানির বড় একটি অঙ্কের টাকা খরচ হয়। তাদের অধিক মুনাফা করতে দেওয়ার দায়িত্ব সরকার কেন নেবে?
বিস্তারিত দেখুন পলিথিন ব্যবহারকে কি সরকার উৎসাহিত করল
ছবি: প্রথম আলো